Monday, December 13, 2021

ফেরা


ইন্টারভিউ বোর্ডের রুমের সামনে বসে আছে মৌ। প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে। এই নিয়ে চতুর্থ ইন্টারভিউ। আগের তিনটা ইন্টারভিউ দিয়েও সুযোগ পায়নি। আজকেও যদি না হয়, তাহলে অনেকটা বিপদে পরে যাবে সে। টেনশনে ঘামছে মৌ। জীবনে কখনো এমন পরিস্থিতিতে পরবে, সেটা কল্পনাও করেনি। কোটিপতি বাবার আদরের মেয়ে, আজ চাকরির জন্য অন্যের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে! যে শহরে তার বাবার এমন দশটা অফিস আছে, সেই শহরের অলিগলিতে একটা চাকরির আশায় ছুটছে মৌ! জীবনের মানচিত্রটা হঠাৎ করেই বদলে গেলো মেয়েটার! তবে এখন আর কারো প্রতি অভিযোগ নেই। বাস্তবতার কঠিন যাতাকলে পরে নিজের ভুলগুলো ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে সে। এখন আর আভিজাত্য, বিলাসী জীবনের প্রতি পিছুটান নেই। এখন শুধু এক টুকরো শান্তির খোঁজে বাঁচতে চায় সে। কারণ তার শরীরে আরেকজনের অস্তিত্ব অনুভব করছে সে। যাকে পৃথিবীতে আনতে হবে। তার একমাত্র সম্পদ, তার সমস্ত ভুল শুধরে দিয়ে তাকে নতুন রূপে বাঁচার প্রেরণা জোগানোর মত একজন! তার অনাগত সন্তান!

-কিরে মৌ? তুই এখানে??
আচমকা ডাকে চমকে উঠলো মৌ! এ কি! এ যে সামিয়া! তার কলেজ জীবনের বান্ধবী!
-এই মৌ! তুই এখানে? কি করছিস??
আমি! আমি মানে! ইয়ে! আমি...
-কি আমি আমি শুরু করেছিস??
না মানে! একটা ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলাম।
-ইন্টারভিউ? কিসের??
চাকরির।
-চাকরির ইন্টারভিউ! তুই দিবি? কি বলছিস এসব?
হ্যা রে। চাকরিটা বড্ড দরকার এখন।
-চাকরি দরকার মানে? কি বলছিস!! আর আবিদ ভাই কোথায়?
আবিদ? সে আছে তার জগতে!
-তার জগতে মানে?
আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
-ও মাই গড! কি বলছিস রে মৌ? আমি তো কিছুই জানি না! কবে হলো এসব?
সে অনেক কথা। ছাড় এসব! তুই এখানে কেন?
-আমি এখানে কেন? আমার অফিস, আমি আসবো না?
তোর অফিস?
-হ্যা, এটাই তো আমাদের কোম্পানি। আমার বাবা এই কোম্পানির চেয়ারম্যান। আমিও গত বছর জয়েন করেছি। লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে পারিবারিক ব্যাবসায় নেমে পড়লাম।
তাই! খুব ভালো করেছিস! খুব ভালো লাগলো তোকে দেখে। কত বছর পর দেখলাম বল!
-হ্যা রে! আমি তো প্রথমে তোকে চিনতেই পারিনি। কাছে এসে বুঝলাম এটা তুই। তুই তো আগের চেয়েও সুন্দর হয়ে গেছিস!
অনেকটা ক্লান্ত চোখেই হাসলো মৌ! সামিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো- আর সুন্দর! জীবনটাই তো এলোমেলো হয়ে গেলো!
-এই চল! আমার রুমে আয়। তোর ইন্টারভিউ হয়ে গেছে। আজকেই তোর জয়েনিং। বেতন কতো দিতে হবে সেই আলোচনা করবো চল। আয়, ভেতরে আয়!
কথা শেষ না হতেই মৌকে টেনে ভেতরে নিয়ে এলো সামিয়া। কলেজ জীবনের পর দুই বান্ধবীর দেখা। অনেক বছর পেরিয়ে গেছে! কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী, ধনী বাবার মেয়ে, বিলাসী জীবনযাপন করা সেই মৌ আজ চাকরির খোঁজে নিজের বান্ধবীর অফিসেই! এখনো অবাক চোখে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে আছে সামিয়া! এই মৌ কি সেই মৌ? এতো পরিবর্তন একটা মানুষের কিভাবে হয়? কি হয়েছে ওর সাথে? কি ঘটেছে ওর জীবনে?
╭┯╮ ┠╂┨ ╰┷╯
চেম্বারে ঢুকেই মৌকে সামনে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলো সামিয়া, আচ্ছা কি হয়েছে বল তো? আবিদ ভাইয়ের সাথে কি হয়েছে তোর? কি সব ডিভোর্স ডিভোর্স করছিস! আর তুই চাকরি খুঁজতে এসেছিস! আঙ্কেল জানে এসব?
প্রশ্নগুলো শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলো মৌ। চোখের কোনায় ধীরে ধীরে পানি জমে যাচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠেই বলতে লাগলো-
বাবা জানে না। জানার চেষ্টাও করে না। তার কাছে আমি এখন মৃত। ছোটবেলা থেকেই আমার সব ইচ্ছা পূরণ করেছে বাবা। পৃথিবীতে এতো আদর, এতো ভালোবাসা কোনো বাবা দিতে পারে কিনা, আমার জানা নেই। আমি কখনোই এসবের যোগ্য ছিলাম না। আমার উচ্চ বিলাসী জীবন, আমার আভিজাত্য, আমার স্ট্যাটাস, এসব আমার রক্তে মিশে ছিলো। তাই বাবার পছন্দ করা আবিদের সাথে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলাম। তুই তো জানিস আবিদ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। আমাদের মতো এতো আভিজাত্য নেই ওদের। বাবার ছোটবেলার বন্ধুর ছেলে হিসেবেই বাবা ওকে পছন্দ করে রেখেছিলেন আমার জন্য। আমি উচ্চ বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত! আমি কিভাবে একটা মিডল ক্লাস ফ্যামিলিতে এডজাস্ট করতে পারবো বল?
তখন তো বুঝিনি, বাবা আমার জন্য সুন্দর একটা ভবিষ্যত দেখেছিলেন আবিদের মাঝে। হয়তো ওর অর্থ বিত্ত নেই, এতো প্রাচুর্য নেই আমার মতো। কিন্তু আমি আবিদকে বুঝতে ভুল করে ফেলেছিলাম সামিয়া। অনেক দেরি করে ফেলেছি ওকে চিনতে। বাবার পরে, আবিদই আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছে। অথচ আমি ওর ভালোবাসা বুঝতে পারিনি। দিনের পর দিন নিজের হেঁয়ালিপনা আর উশৃঙ্খলতায় ওর সংসারটাই তছনছ করে ফেলেছি রে! আর অবশেষে, আজ আমি নিঃস্ব! একাকী। বাঁচার মতো কোনো অবলম্বন নেই আমার।
- সংসার তছনছ করে ফেলেছিস মানে? কি করেছিস?
বিয়ের পর থেকেই ওই বাড়িটা আমার অসহ্য লাগতো। নিজেকে বড্ড সাধারণ মনে হতো। ছোট ছোট ঘর, মধ্যবিত্ত পরিবার! বাবার প্রতি প্রচন্ড রাগ হতো। জানিস, আমার শ্বশুর মানুষটা অনেক ভালো। একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন তিনি। এখন রিটায়ার্ড। আমার শাশুড়িও মাটির মানুষ। কতো যে স্নেহ মমতায় রাখতেন আমায়! কিন্তু আমি সেটা বুঝিনি। বিয়ের দিন থেকেই আমি মনস্থির করে নিয়েছিলাম, এই সংসার আমি করবো না। তাই শ্বশুর শাশুড়ির স্নেহ মমতা আমার কাছে নাটকীয় মনে হতো। ভাবতাম হয়তো অর্থের লোভে বড় বাড়ির মেয়ের সাথে নিজের সাধারণ ছেলেকে বিয়ে দিয়েছে এরা। আর আমাকে মিথ্যা স্নেহ করে বশ করার চেষ্টা করছে। শিল্পপতি আহসান তালুকদারের মেয়ে বলে কথা!
নিজের এই ভাবনা গুলো যখন বাবার সাথে শেয়ার করতাম, তিনি আমাকে ধীরে ধীরে ঘৃণা করতে শুরু করলেন! বাবা তো একদিন বলেই বসলেন, তোকে জন্ম দিয়েই আমি ভুল করেছি। তোর মত নিকৃষ্ট মনের মেয়ে আর দ্বিতীয়টা হয় না। সেদিনের পর থেকে বাবার বাড়িও যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আর সেই রাগ, ক্ষোভ ঝেড়েছি আমার স্বামী, শ্বশুর শাশুড়ির উপরে। আমার উগ্রতার কারণে সেই সোনার সংসারটা ধীরে ধীরে নরকে পরিনত হতে লাগলো।
একদিন বাসা থেকে কোনো এক অজুহাতে বেরিয়ে রাকিবের সাথে দেখা করলাম। রাকিব আমাকে ফুসলিয়ে ডিভোর্স নিতে বললো। আরও উশৃঙ্খল হতে বললো, যেন আবিদ নিজেই আমাকে ডিভোর্স দেয়। আমিও সেভাবেই করতে লাগলাম। সংসারের কোনো কাজে কখনো আমি হাত দেইনি। যত দিন যাচ্ছিলো, ঝামেলা শুধুই বেড়েছে। আবিদও অনেক চেষ্টা করেছে আমাকে আগলে রাখার। আমিই মুক্তি চেয়েছি শুধু।
যেদিন আবিদের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি, সেদিন রাকিবের এক বান্ধবীর বাসায় উঠেছিলাম। তারপর থেকেই আমি রাকিবকে চিনতে পারি! এতো নোংরা একটা মানুষের কথায় আমি নিজের সংসারটা শেষ করে এসেছি! পরের মাসেই সেখানে থেকে বেড়িয়ে এসে একটা ছোট বাসা নিয়েছি। হাতে যা কিছু ছিলো নিজের, সবটুকুই শেষের দিকে। বেঁচে থাকার তাগিদে একটা চাকরির জন্য চেষ্টা করছি। তিনটা ইন্টারভিউ দিয়েছি। কোথাও সুযোগ পাইনি। নিজের সমস্ত অহংকার, ব্যক্তিত্ব সবকিছু আজ অর্থহীন মনে হচ্ছে। বাবার অর্থ প্রতিপত্তি ছাড়া, আমি নিতান্তই সাধারণ একটা মেয়ে। একটা চাকরি জোগাড় করার যোগ্যতাও যার নেই! নামিদামি ভার্সিটিতে পড়লেই কেউ যোগ্য হয়ে যায় না। তার সবচেয়ে বড় প্রমান হয়তো আমিই! জীবনের আসল যুদ্ধে বাকি সব যোগ্যতা হারিয়ে যায় রে! সব অহংকার মাটিতে লুটিয়ে যায়!
কাঁদতে কাঁদতে নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো মৌ, আমি এখন শুধু ওর জন্যই বাঁচতে চাই!
চমকে উঠলো সামিয়া!!
-তুই প্রেগন্যান্ট??
হ্যা !! ক্লান্ত গলায় বললো মৌ!
╭┯╮ ┠╂┨ ╰┷╯
তুই প্রেগন্যান্ট ! উফ, এতো আনন্দ লাগছে আমার! এতো বড় খুশির সংবাদ এভাবে দেয় কেউ? গাধী মেয়ে একটা!
মনটা খুশিতে ভরে গেলো রে মৌ!! তবে আমার কাছে অবাক লাগছে এই ভেবে যে, আঙ্কেল তোকে এক্সেপ্ট করলো না! কিংবা তোর খোঁজও করছে না? এটা কিভাবে সম্ভব!
যে মেয়ে মৃত, তার খোঁজ কিভাবে করবে বল? সবচেয়ে আদরের সন্তান যখন নিজের ভুলে একে একে সবকিছু শেষ করে ফেলে, তখন সেই সন্তানের অস্তিত্বও শেষ হয়ে যায় বাবা মার কাছে। বাবা হয়তো অন্ধকারে কাঁদেন আমার জন্য। যেমনটা আমি কাঁদি। জীবনে কিছু মুহূর্ত সমস্ত হিসাব নিকাশ বদলে দেয় সামিয়া। বেঁচে থাকাটাও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পরে তখন।
মৌয়ের কান্নাভেজা কণ্ঠে সামিয়ার বুকটাও ভারি হয়ে এলো! এতো সুন্দর জীবনটা একদম তছনছ করে ফেলেছে মেয়েটা। আবিদের মতো একজন কেয়ারিং হাজব্যান্ডকে পর্যন্ত ডিভোর্স দিয়ে আজ একাকী বাঁচার লড়াইয়ে যুদ্ধ করছে সে! কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সামিয়া। তারপর বলে উঠলো- চল মৌ, তুই আজ থেকে আমার সাথে থাকবি। আর কাল থেকেই অফিসিয়ালি জয়েন করবি তুই। তোর সামনে অনেক লম্বা পথ ছুটতে হবে। ভেঙে পরলে চলবে না।
নারে, আমি কারো বোঝা হতে চাই না- বলে উঠলো মৌ!
আমি ঠিক আছি, আমাকে নিয়ে ভাবিস না। এই মুহূর্তে চাকরিটার বড্ড প্রয়োজন ছিলো। তুই আবার আশীর্বাদ হয়ে এলি আমার জীবনে। এতেই আমি খুশি।
- তুই আমার কাছে বোঝা হবি কেন? বোকা মেয়ে! কি বলছিস এসব?
সরি রে। তবে আমি ঠিক আছি। আমাকে নিয়ে ভাবিস না।
- ঠিক আছে, ভাববো না। চল, তোকে বাড়ি পৌঁছে দেই। তোর বাড়িটাও চিনে আসি। নাহলে আমি চিন্তায় থাকবো।
মৌকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সামিয়া। ঢাকার সবুজবাগ থানার বাসাবো এলাকায় একটি তিনতলা বাড়ির সামনে থামলো গাড়ি। এখানেই উঠেছে মৌ। ছাদের চিলেকোঠায় এক রুমের একটি ছোট্ট বাসা। সাথে ছোট্র একটি রান্নাঘর। সামিয়া খুব কষ্ট পেলো মৌয়ের এই ঠিকানা দেখে। কতো বড় বাড়ির মেয়ে মৌ। আর আজ একি অবস্থায় থাকছে মেয়েটা! এসব ভাবছে সামিয়া, এমন সময় সামিয়ার জন্য চা করে নিয়ে এলো মৌ। চা হাতে মৌকে দেখে চোখের কোনায় পানি জমে এলো সামিয়ার!
- তুই রান্না করিস?
হ্যা, এখন নিজেই করতে হয় সব। বেশিকিছু পারি না। টুকটাক করি যতটুকু পারি। একলা মানুষ। দু মুঠো খেতে পারলেই হয়ে যায়। কথাটা শুনেই মুখটা ঘুরিয়ে নিলো সামিয়া। চোখ গড়িয়ে পানি পরছে। মৌ দেখলে কষ্ট পাবে।
- আজ আমি যাই রে! কাল সকালে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দেব। এসে তোকে নিয়ে যাবে অফিসে।
না রে। আমি চলে যাবো। কাছেই তো। গাড়ি পাঠাতে হবে না। অনেক করেছিস তুই। আমাকে আর ঋণী করিস না।
- ঠিক আছে মৌ। তাই হবে। যাচ্ছি আমি। বলেই উঠলো সামিয়া। হঠাৎ জানালা দিয়ে নিচে চোখ যেতেই মৌকে ডেকে বললো, এই মৌ এদিকে আয় তো! রাস্তায় দাঁড়ানো ওই লোকটাকে চিনিস?? মাথায় হেলমেট পরে আছে!
এগিয়ে এসে দেখলো মৌ! কই, নাতো!!
কেউ একজন তাদের ফলো করছে। মৌয়ের বাড়ি পর্যন্ত এসেছে সেই বাইকটা। সামিয়া মৌকে বললো, এই বাইকটা আমার অফিসের সামনে থেকেই পেছনে আসছে। বিষয়টা খেয়াল করেছিলি??
মৌ বললো, আমি তো খেয়াল করিনি। তবে আমিও কিছুদিন ধরে বুঝতে পারছি যে কেউ আমাকে ফলো করছে! কেমন জানি মনে হয়, কেউ আমার চারপাশে ঘুরছে শুধু।
- বলিস কি?? নতুন কোনো আশিক পেছনে লাগলো নাকি??
ধুর, কি বলিস! আমার পেছনে আর কে লাগবে? হয়তো আমার মনের ভুল!
- কিন্তু আমি তো ভুল করি না। আমি নিশ্চিত এই বেটা আমাদের পেছনে পেছনে এসেছে।
কিছুটা চিন্তিত হয়ে গেলো মৌ! তাহলে কি রাকিব ওর পেছনে লোক লাগিয়েছে? ওর কোনো ক্ষতি করতে চায়?? অদ্ভুত এক ভয় মৌয়ের মনে বাসা বাঁধলো!! রাকিব কি এখনো ওর পেছনে লেগে আছে তাহলে? সেদিনের সেই থাপ্পড়ে ওর শিক্ষা হয়নি। আরও কঠিন শাস্তি দেয়া দরকার ছিলো। ওর ফাঁদে পরেই নিজের সংসারটা নষ্ট করেছে মৌ। যত দিন গেছে, রাকিবকে চিনতে পেরেছে মৌ। রাকিবের সেই বান্ধবীর বাড়িতে থাকাকালীন রাকিবের কুকর্ম দেখে মৌ চমকে উঠেছে! তার কাছে মৌ যা, অন্য সকল মেয়েও তাই! যেদিন প্রথম নেশা করালো মৌকে, রাতে জোর করে মৌয়ের শরীরে স্পর্শ করতে চাইলো, সেদিনই মৌ নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। সেই রাকিব আবার তার পেছনে লেগেছে? কি চায় সে?
পরদিন থেকে অফিসে জয়েন করলো মৌ। নতুন জীবনের শুরু করলো। প্রিয় মানুষগুলোকে হারিয়ে, সম্পূর্ণ একাকী এক পথচলা! অফিসের ফোন থেকে বাবার কাছে ফোন করলো মৌ। ওপাশে ফোন ধরতেই বাবার কন্ঠ! কতদিন পর বাবার কন্ঠ শুনছে মৌ! বাবা হ্যালো হ্যালো করছে, মৌ চুপ করে শুধু শুনছে বাবার কন্ঠ। হ্যালো বলার সাহস হচ্ছে না। কারণ ওর কন্ঠ শোনামাত্র লাইনটা কেটে দেবেন বাবা। তাই পরিচয় না দিয়ে নিজেই রেখে দিলো মৌ। পরের টেলিফোনটা করলো আবিদের নাম্বারে। আবিদ ফোন রিসিভ করতেই মৌয়ের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো!! এটা কেমন অনুভূতি! আগে তো এমন অনুভূতি হয়নি কখনো! মৌ কি আবিদকে ভালোবাসছে এখন? আবিদের কণ্ঠ মৌয়ের সমস্ত অনুভূতি স্পর্শ করে গেলো। এতদিন একসাথে সংসার করেছে, এমন অনুভূতি হয়নি কখনো! ওপাশে হ্যালো হ্যালো করছে আবিদ। ফোনটা রেখে দিলো মৌ!
এই পৃথিবীতে তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা দুইটা মানুষের কন্ঠ শুনলো মৌ। কিন্তু আজ তাদের কাছে নিজের নামটা বলার মতো সাহস তার নেই। বুকভরা আর্তনাদ নিয়ে নতুন জীবন শুরু করলো মৌ।
╭┯╮
┠╂┨ ╰┷╯
অফিস শেষ করে বের হতেই মৌ বুঝলো, কেউ তার পেছনে আসছে। কিন্তু কে? কাউকেই সেভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আশেপাশে কতো মানুষ! কে তাকে অনুসরণ করছে প্রতিদিন? প্রতি মুহূর্তে ভয় বাড়তে লাগলো মৌয়ের। কে ফলো করছে তাকে? সেদিন সকালে দরজা খুলতেই একটা ফুলের তোড়া দরজার সামনে পেয়েছে মৌ। সেখানে লেখা ছিলো Congratulations !! সেদিনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো মৌ। তাকে কেউ ফলো করছে! তার সমস্ত আপডেট সেই লোক জানে। কিন্তু কে সে? সামনে কেন আসছে না? গত পরশু দিনও মৌয়ের অফিসের নাম্বারে কেউ একজন ফোন করে চুপ করে ছিলো। কোনো কথা বলেনি। মৌয়ের অফিসের টেলিফোন নাম্বার সে পেলো কোথায়? তারমানে মৌ যে এখন মোবাইল ব্যবহার করে না, এটাও সে জানে! এজন্যই অফিসের টেলিফোন নাম্বার জোগাড় করেছে? কি চায় সে?
হাঁটছে আর ভাবছে মৌ! কে এই লোকটা? কেন এভাবে ফলো করছে মৌকে! তার উদ্দেশ্য কি? রাকিব নয় তো?
পরেরদিন সামিয়াকে বিষয়টা জানালো মৌ। সামিয়া নিজেও একটু চিন্তিত মনে হলো!
- তোকে সেদিন বলেছিলান না, কেউ তোর পিছু করছে!
আমার পিছু করার মতো কে থাকতে পারে বল? রাকিব এমন করছে কি?
- করতেও পারে। ওর পার্টিতে ওকে থাপ্পড় দিয়েছিস, সেই জেদ থাকাই তো স্বাভাবিক!
ওসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করে না। বাদ দে। ক্ষতি করতে চাইলে করুক। আমার নতুন করে ক্ষতি আর কি হবে? আমি তো এমনিতেও নিঃস্ব!
সেদিন অফিস থেকে বের হতেই একটা ছোট বাচ্চা মৌয়ের হাতে একটা ছোট্র কাগজ দিয়ে দৌড়ে চলে গেলো। তাতে লেখা - দেখা হবে শীঘ্রই! চিরকুট টা পড়ে চমকে উঠলো মৌ! চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। এতো মানুষের ভিড়ে, কে হতে পারে? ধীরে ধীরে অজানা ভয় গ্রাস করছে মৌকে।
একদিকে নতুন অফিস, কাজের চাপে অতীতের সবকিছু ভুলে থাকার চেষ্টা করছে মৌ। নতুন এক জীবনের শুরু করেছে মৌ। তার অনাগত সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখতে হবে। একমাত্র এই একটা সম্পদই শুধু আছে তার। আর কেউই নেই। সবাই আজ দূরে। আজ একাকী মৌ! সম্পূর্ণ একা! দেখতে দেখতে দুইটা মাস কেটে গেছে। অফিসের সবাই মৌকে পছন্দ করছে এখন। তার মেধা আর শ্রম দিয়ে সকলের মন জয় করে নিয়েছে মৌ। সামিয়ার বাবা সেদিন বললেন, তোমাকে পেয়ে আমরা গর্বিত। তুমি অনেকদূর যাবে। সামিয়া নিয়মিত খেয়াল রাখছে। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা করে আবিদ কে দেখতে। কিন্তু নিজের ইচ্ছায় লাগাম টানে মৌ। টেলিফোন করে আবিদের কন্ঠ শুনে, নিশ্চুপ রেখে দেয় ফোনটা। এর বেশিকিছুর যোগ্য সে নয়! আবিদ হয়তো অনেক ভালো আছে। বাবাও ভালো আছেন। নিয়মিত অফিস করছেন। সেদিন দূর থেকেই একনজর বাবাকে দেখে এসেছে মৌ। দূর থেকে প্রিয় মানুষদের দেখার মাঝেও এক বুক তৃপ্তি আছে।
সবকিছুই ঠিক চলছিলো। নিজেকে নতুন করে গড়তে শিখেছে মৌ। কিন্তু এই মুহুর্তে একটা অজানা আতঙ্কে মৌয়ের শরীর কেঁপে উঠছে! কিছুক্ষণ আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ছুটে এসে দরজা খুলেছে মৌ! অথচ বাইরে কেউই নেই! শুধু একটা চিরকুট পরে আছে। তাতে লেখা- ‘কাল দেখা হচ্ছে।’ লেখাটা পড়ে ভয়ে জমে যাচ্ছে মৌ! কি হচ্ছে তার সাথে এসব? কে এই ব্যক্তি? কে ফলো করছে তাকে? কাল দেখা হচ্ছে মানে! সে কি সামনে আসবে? কে সে?
ভয়ে ঘামছে মৌ! তার সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে কাল!
╭┯╮
┠╂┨ ╰┷╯
ঘুম থেকে উঠেই ভয় আর আতঙ্ক নিয়েই অফিসে এলো মৌ! অফিসে এসে সামিয়াকে বিষয়টা জানাতে চাইলো, কিন্তু সামিয়া অফিসে নেই। সামিয়ার ফোনটাও বন্ধ! ব্যাপার কি? সারাদিন অফিসে কাজে মন বসলো না মৌয়ের! সামিয়া আজকে অফিসেও আসেনি। মোবাইল বন্ধ। বাড়িতে টেলিফোন করে জানলো সামিয়া বাড়িতেও নেই! ব্যাপার কি? এদিকে মৌ এর চিন্তা বাড়তে থাকলো। অফিস টাইম শেষ প্রায়। কিন্তু অফিস থেকে বের হতেও ভয় পাচ্ছে মৌ! কালকের সেই চিরকুটের কথা মনে পরে যাচ্ছে বার বার। কে সেই ব্যক্তি? দিনের পর দিন মৌকে ফলো করছে। আজকে মৌ এর সামনে আসার কথা জানিয়েছে। সত্যিই কি সে আসবে সামনে? কে সে?
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে, সামিয়ার কোনো খবর নেই! অফিস শেষে ভয়ে ভয়ে রাস্তায় বের হলো মৌ। প্রচন্ড চিন্তা আর ভয়ে বাসায় যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। ইচ্ছা করছে আজ সারা সন্ধ্যা এমনকি সারারাত রাস্তায় হেটে বেড়াবে। তার কোনো ঠিকানা নেই। কেউই নেই। চোখ বন্ধ করে পথ চলতে থাকবে সে। যে পথ কোথাও থামবে না। যে পথের শেষ নেই। যে পথে কোনো ভয় নেই, হারাবার কিছু নেই। চলে যাবে অনেক দূরে, সবার থেকে আড়ালে। নিজের অনাগত সন্তানকে নিয়ে অনেক অনেক দূরে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে তার! স্বামী, সংসার, নিজের পরিবার সবকিছু হারিয়েছে! এখন এই অজানা আতঙ্ক তাকে প্রতি মুহূর্তে শেষ করে দিচ্ছে! না, আর কিছুই ভাবতে পারছে না মৌ। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো রাস্তায়। হাজারও মানুষ ছুটছে তাদের গন্তব্যে। অথচ তার কোনো গন্তব্য নেই। কেউই নেই।
রাত ৯ টা বাজে। গন্তব্যহীন হেটে চলেছে মৌ। সামিয়ার কোনো খোঁজ পায়নি। সামিয়ার বাড়িতে গিয়েছিলো, সেখানে নেই। সামিয়া নাকি বলেছে আজ ফিরতে দেরি হবে। জরুরি কাজ আছে। কিন্তু ফোন কেন বন্ধ, এটা জিজ্ঞাসা করতে ওর মা বললেন তিনিই জানেন না। তবে উনাকে তেমন চিন্তিত মনে হলো না! বিষয়টা অদ্ভুত লাগলো মৌ এর। এমনকি সামিয়ার বাবা-মা মৌকে অপেক্ষা করতেও বললেন না। এমন তো কখনো হয়নি। মৌ যতবার ওই বাড়িতে গিয়েছে, ততবার তাকে থেকে যাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করতো সামিয়ার বাবা মা দুজনেই। মৌকে যথেষ্ট স্নেহ করেন এই দুজন মানুষ। কিন্তু আজ তারাও অদ্ভুত আচরণ করছে! যেন মৌ তাদের শুধু পরিচিত অতিথি মাত্র! তাদের আচরণ মৌকে কষ্ট দিলো।
সেখান থেকে বেড়িয়ে তালুকদার ম্যানশনের সামনে এসে দাঁড়ালো মৌ! তার বাবা আহসান তালুকদারের অফিস। খুব ইচ্ছা করছে ছুটে বাবার কাছে যেতে। বলতে ইচ্ছা করছে, বাবা আমি ভয় পাচ্ছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা। আমি বদলে গেছি। নিজেকে নতুন করে গড়েছি। তুমি সবসময় যেমনটা চেয়েছিলে, আমি তেমন মেয়ে হয়েছি আজ। বাবা, আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমি ছাড়া আমার কেউই নেই পৃথিবীতে। বাবা, আমাকে আবিদের কাছে নিয়ে যাও। আমি ওর সন্তানকে জন্ম দিচ্ছি বাবা। আমি আবিদের ভালোবাসার পূর্ণতা দিচ্ছি। আমাকে তোমরা ক্ষমা করে বুকে টেনে নাও। আমি বদলে গেছি বাবা!
মৌ পারেনি। যে বাঁধন ছিড়ে গেছে, সে বাঁধন আর জোড়া লাগে না। যে বাবা গত তিন মাসেও তার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেনি, সেই বাবার কাছে সে এখন মৃত! সেখানে তার আর জায়গা নেই! সে চাইলেই সবকিছু ঠিক করতে পারবে না। তার সেই অধিকার আর নেই। যেদিন বাবা নিজের অধিকারে তাকে বুকে টেনে নেবে, সেদিন সে নিজেকে ক্ষমা করে ফিরে যাবে বাবার বুকে! তার আগে নয়। তার আগে বাবার বুকে ফিরে যাওয়ার অধিকার সে হারিয়েছে।
প্রচন্ড ক্লান্তি আর ভয়কে কাটিয়ে অবশেষে মনে সাহস সঞ্চার করে বাড়ির পথে রওনা হলো মৌ! রাস্তায় হাঁটছে, আর কেমন জানি মনে হচ্ছে পেছনে কেউ আসছে! পেছনে ফিরে তাকানোর সাহস হলো না মৌয়ের! সে সোজা বাড়ির পথে ছুটছে দ্রুত গতিতে। সে জানে এই মুহূর্তে তার পেছনে সেই লোকটা আছে। কিন্তু তাকে দেখার সাহস হচ্ছে না কেন? মৌ নিজেকে শক্ত করতে চেয়েও পারছে না। না, সে তাকাবে না। যা কিছুই ঘটুক, সে পেছনে তাকাবে না। সে দ্রুত পায়ে ছুটে যাচ্ছে বাড়ির দিকে।
বাড়িতে ঢোকার সময় প্রচন্ড সাহস নিয়ে একবার পেছনে তাকালো মৌ! কই, কেউই তো নেই! আশেপাশে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না! বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো মৌ! মনের ভয় কিছুটা কমলো, যেন বুকের উপর থেকে একটা পাথর নেমে গেছে মাত্র! এক টুকরো শান্তির নিঃশ্বাস নিলো মৌ! কিন্তু সেটা স্থায়ী হলো না! ছাদে উঠতেই পরিবেশটা একটু অদ্ভুত লাগলো মৌয়ের! নিজের রুমের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলো মৌ। তবে আসল ভয়টা এবার পেলো! তার রুমের দরজা খোলা! ভেতরে কিছু মানুষের আনাগোনা দেখতে পাচ্ছে মৌ! চমকে উঠলো মৌ! রুমের চাবি তো শুধুই তার কাছে, তাহলে ভেতরে কারা? ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো মৌ! এবার যেন থমকে গেলো একদম! নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না সে! শরীরটা এখন কাঁপছে! প্রচন্ড কাঁপছে!!
╭┯╮
┠╂┨ ╰┷╯
দড়জার কাছে এসে চমকে উঠলো মৌ! সে কি স্বপ্ন দেখছে? নাকি সত্যি! অদৃশ্য এক মায়াজাল যেন বন্দি করে নিয়েছে তাকে। এক পা সামনে এগুবার মতো শক্তি নেই! স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মৌ! রুমের ভেতর থেকে সামিয়া ছুটে এসে মৌয়ের হাত ধরে তাকে টেনে ভেতরে নিয়ে এলো। ভেতরে যে মানুষ গুলো আগ্রহ চোখে তার জন্য অপেক্ষা করছে, তারা সবাই তার পরিচিত। পরিচিত নয়, তারাই তার পৃথিবী! তার সমস্ত জগত ঘিরে এই মানুষ গুলোই।
তার বাবা আহসান তালুকদার এগিয়ে এসে দুই হাতে মৌয়ের গাল চেপে বললেন, হ্যাপি বার্থডে মামনি! হ্যাপি বার্থডে! কথাটা বলতে গিয়েই কেঁদে ফেললেন তিনি। অঝোরে কাঁদলেন শব্দ করেই! তারপর অস্পষ্ট স্বরেই বললেন- মা রে তুই ভাবলি কিভাবে তোর বাবা তোকে ভুলে গেছে? আমি তোকে ভুলিনি মা। তোর প্রতি আমার কোনো রাগ অভিমানও নেই। শুধু তোকে জীবনযুদ্ধের বাস্তব চিত্রটা দেখাতে চেয়েছিলাম। তোর ভেতরের মানুষটাকে জাগাতে চেয়েছিলাম রে মা। কষ্ট আর হারানোর তীব্র যন্ত্রনা তিলে তিলে একটা মানুষকে খাঁটি করে তোলে। তুই এখন খাঁটি একজন মানুষ। তুই নিজের খারাপ সত্তা ভেঙে টুকরো করে নিজেকে নতুন করে গড়েছিস মা।
মৌ কাঁদছে, নিস্তব্ধ হয়ে আছে! তার মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে যেন জনম বোবা! হঠাৎ সামিয়া বলে উঠলো- সেদিন তোকে অফিসে দেখে আমিও ভেঙে পড়েছিলাম মৌ। তোকে বুঝতে দেইনি। তোর কাছে সবকিছু শুনে তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই আমি সোজা চলে গেলাম আঙ্কেলের কাছে। গিয়ে কি দেখলাম জানিস মৌ? আঙ্কেল তোর ছবিটা বুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। আমি উনাকে সবকিছু খুলে বললাম। তোর বর্তমান অবস্থা এবং তুই যে আমার কাছেই আছিস, সেটা শুনে আঙ্কেলের বুক থেকে যেন একটা পাথর নামলো। সেদিন থেকে আমি প্রতিদিন তোর আপডেট আঙ্কেল কে দিয়ে এসেছি। তুই ভাবছিস আঙ্কেল তোকে ত্যাগ করেছে? না রে মৌ! গত তিন মাস যাবৎ আমি নিয়মিত আঙ্কেলের সাথে যোগাযোগ রেখেছি। আঙ্কেল দূর থেকে তোকে দেখে যেত মাঝে মাঝেই! যেমনটা তুই দূর থেকে আঙ্কেলকে দেখিস!
মৌ ধীরে ধীরে কথা বলার চেষ্টা করছে। তার সমস্ত নীরবতা ভেঙে সে বাবা বলে ডেকে উঠলো! বাবার বুকে মাথা গুঁজে দিলো কান্নায়। চিৎকার করে কাঁদছে সে!! কান্নায় এতো তৃপ্তি কেন? এতো তৃপ্তি সে আগে কখনো পায়নি। পেছন থেকে সামিয়ার বাবা-মা এগিয়ে এলেন। বললেন- মা গো, আজ তোমাকে মনে কষ্ট দিয়েছি। কিছু মনে করো না। সামিয়া বললো আজ তোমার সব কষ্টের অবসান হবে। সবাইকে নিয়ে তোমাকে সারপ্রাইজ দেবে। আজ তোমার জন্মদিনেই তোমার নবজন্ম হবে। তাই তোমাকে বলতে গিয়েও বলতে পারিনি। এমন একটা মুহূর্ত আমরা নষ্ট করি কিভাবে বলো? তোমার পৃথিবী আজ তুমি আবার ফিরে পেলে মা। তোমার জন্মদিনে এটাই আমাদের ছোট্র উপহার।
হ্যাপি বার্থডে মৌ!
পেছন থেকে একজনের কণ্ঠে হঠাৎ চমকে উঠলো মৌ! তাকিয়ে দেখলো আবিদ দাঁড়িয়ে! সত্যিই কি আবিদ? সমস্ত শরীর কাঁপছে মৌয়ের! হ্যা, আবিদই তো! আবিদ এসেছে!
সামিয়া এগিয়ে এসে আবিদের হাত ধরে টেনে নিয়ে একদম মৌয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে বললো, নিন! আপনার বউকে সামলান। অনেক হয়েছে লুকোচুরি খেলা। এবার শেষ হোক সবকিছু।
নিজের হাতে মৌয়ের চোখ মুছে দিয়ে আবিদ বললো- মৌ কাঁদছো কেন? আজ তো তোমার সুখের দিন। যা কিছু হারিয়েছিলে, সেই সবকিছু আজ তোমার সামনে। তোমার প্রিয় মানুষগুলো সব! তারপর নিজের চোখ মুছতে মুছতে আবিদ বললো- যদিও আমি তোমার প্রিয় কেউ না, তবে তুমি আমার সমস্ত পৃথিবী। তোমাকে ছাড়া প্ৰতিটা মুহূর্ত নিজেকে শূন্য মনে হয়েছে। বার বার ভেবেছি, সবকিছু ভুলিয়ে তোমাকে বুকে টেনে নেই। কিন্তু বাবা আমাকে আদেশ করেছিলেন, আমি যেন তোমাকে একলা ছেড়ে দেই! জীবনের কঠিন পথে চলতে চলতেই তুমি শিখে যাবো, তুমি কি হারিয়েছো! কাদের হারিয়েছো! বুঝে যাবে সম্পর্কের মূল্য, ভালোবাসার মূল্য। তখন তুমিই ফিরবে আমাদের কাছে। খুঁজে নেবে তোমার প্রিয় মানুষ গুলোকে। আমি তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি, এই ভাবনাটাই হয়তো তোমাকে শক্ত হতে সাহায্য করেছে। তুমি হেরে যাওনি, নিজেকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছো। নতুন করে জীবন শুরু করেছো। আমাদের সন্তানকে নতুন পৃথিবীর মুখ দেখাতে তুমি নিজেকে শক্ত করে জীবনের নতুন সংগ্রামে নেমে গেছো !! তুমি অবশেষে নিজেকে খুঁজে পেয়েছো মৌ! নিজেকে খুঁজে....
আবিদ কথাটা শেষ করতে পারলো না। মৌকে বুকে টেনে নিয়ে অঝোরে কেঁদে ফেললো! আবিদের বুকে শক্ত করে লেপ্টে আছে মৌ। তার বুক চিরে কান্না আসছে! চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। বলতে ইচ্ছা করছে, আবিদ আমি কি এতো সুখের যোগ্য? আমাকে এতো ভালোবাসো কেন আবিদ? আমি কি এতো ভালোবাসার যোগ্য?
আহসান সাহেব এগিয়ে এলেন। বললেন, মা রে! আবিদ এক মুহূর্তের জন্যও তোকে একা ছাড়েনি। প্রতি মুহূর্তে তোর পেছনেই ছিলো! সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ছায়ার মতো তোর পাশে থেকেছে। তুই বাড়ি ফেরা পর্যন্ত তোর বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে থেকেছে। অদৃশ্য এক শক্তির মতো তোকে আগলে রেখেছে আড়াল থেকে।
সামিয়া বলে উঠলো, হ্যা মৌ! তুই যার ভয়ে অস্থির থাকিস, এই সেই পিছু মানব। যিনি সবসময় তোকে ফলো করেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তোকে অনুসরণ করেন। তোর সেই ফলো ম্যান!! তোর জামাই, আবিদ দুলাভাই!! বুঝলি??
মৌ মুখ তুলে একবার আবিদের দিকে তাকালো। তারপর আবার মুখ গুঁজে দিলো আবিদের বুকে। এই বুকটাই যেন তার একমাত্র ঠিকানা। তার শেষ আশ্রয়!!
আহসান সাহেব এগিয়ে এসে কন্যা ও জামাইকে একসাথে বুকে জড়িয়ে নিলেন। নিজেও কাঁদলেন। সামিয়া কাঁদলো। মৌয়ের প্রিয় মানুষ গুলো কাঁদলো। যেন আজ কান্নার দিন! কেঁদে সকলের সব দুঃখ ভাসিয়ে দেয়ার জন্যই সবাই একত্রিত হয়েছে। এই কান্না শেষে নতুন সুখের জগত শুরু হবে। হাসিময় এক পৃথিবীর সূচনা কান্না দিয়েই শুরু হয়। মৌ ফিরেছে তার আপন ভুবনে।
আহসান সাহেব তার মেয়ে ও জামাইকে নিয়ে কেকের দিকে এগিয়ে গেলেন। আজ তাঁর মেয়ের জন্মদিন। আজ তার মেয়ের নতুন পৃথিবীর সূচনা। আজ তার খুশির দিন। আজ তার ফেরার দিন।
( সমাপ্ত )

No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...