Thursday, December 9, 2021

অধিকার


অফিস যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে সুজন। ব্লেজারটা বের করে হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে লিজা। অনেকক্ষণ ধরেই কিছু একটা বলবে ভাবছে। তবে বলার সাহস পাচ্ছে না। ইতস্তত করছে। সুজন আর লিজার বিয়ের ৪ মাস হয়েছে মাত্র। মেয়েটা এখনো সেভাবে সহজ হতে পারেনি হাজব্যান্ড এর সাথে। স্বামী হিসেবে সুজনকে যতটা সম্মান করে, তারচেয়ে বেশি ভয় পায় লিজা। কারণ নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এমন মর্যাদাপূর্ণ একটি পরিবারে স্ত্রী হয়ে আসতে পারার সৌভাগ্য হবে, সেটা কখনো কল্পনাও করেনি লিজা।

বিয়ের পর থেকেই চিরচেনা পৃথিবী ছেড়ে এই অভিজাত্যের পৃথিবীতে মানিয়ে নেয়ার লড়াইটা করে যাচ্ছে লিজা। সুজন লিজাকে পছন্দ করে কিনা, সেটাও আজ পর্যন্ত বুঝতে পারেনি লিজা! অথচ বিয়ের পর থেকেই মনে মনে সুজনকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছে লিজা। তবে মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস হয়নি। এমনকি নিজের কোনও প্রয়োজনের কথাও বলার সাহস হয়ে উঠেনা লিজার! আজকে একটা বিশেষ প্রয়োজন ছিলো। সেটা বলার জন্যই সকাল থেকে চেষ্টা করছে লিজা। বলতে গিয়েও থমকে যাচ্ছে বার বার।
- তুমি কিছু বলতে চাও?
আচমকা সুজনের প্রশ্নে বিপাকে পড়ে গেলো লিজা!
- কি হয়েছে? কিছু বলবে?
- না মানে! ইয়ে! না কিছু না!
বলতে গিয়েও থমকে গেলো লিজা। মাথা নিচু করে ব্লেজারটা এগিয়ে দিলো।
- হাতে সময় নেই। যদি কিছু বলতে চাও বলতে পারো।
- না মানে। ইয়ে, আসলে!
- কি ইয়ে ইয়ে শুরু করলে!
- আসলে আমার কিছু টাকার দরকার ছিলো।
- টাকা? কতো টাকা?
- দুই হাজার!
কথাটা বলেই লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখলো লিজা। বিয়ের পর এই নিয়ে তৃতীয়বার স্বামীর কাছে টাকা চাইলো লিজা। সেটাও নিজের জন্য নয়। ছোট ভাই লিমনের জন্য। কালকে ওর কলেজের ফর্ম ফিলাপের শেষ দিন। টাকাটা জোগাড় হয়নি। লজ্জা ঝেড়ে ফেলে অবশেষে বোনের কাছে কাছে সাহায্য চাইলো লিমন! কারণ তাদের বাবা রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষক। রোজগার বলতে শুধু বাসায় টিউশনি করেন কিছু ছাত্র ছাত্রীর। মাঝামাঝি সময়ে এই পরিবারে বাড়তি খরচ করার মতো টাকাপয়সা হাতে থাকে না বললেই চলে। মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়েও ধার দেনা অনেক করে ফেলেছেন। তাই আর কারো কাছেই হাত পাততে চান না। যদিও তিনি বলেছেন জোগাড় করবেন। তবে লিমন জানে, উনার কষ্ট হয়ে যাবে।
তাই লজ্জা ভেঙে বোনের কাছেই ধার চাইলো। কিছুদিন আগে বাবা স্ট্রোক করেছিলেন। লিজাকে সেটাও জানানো হয়নি। নতুন সংসার। অযথা বাবার অসুস্থতার কথা শুনে ছুটাছুটি করবে। লিজার মা নিষেধ করেছিলেন সবাইকে লিজাকে যেন জানানো না হয়! হাসপাতালে অনেক টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিলো। জরুরি দরকার বলে বোনের কাছে কিছু টাকা চেয়েছিলো লিমন। কিন্তু বাসায় সেটা বলার সাহস হয়নি। বাবা-মা দুজনেই রাগ করতেন! বাসায় বলেছে নতুন টিউশনি নিয়েছি। অগ্রিম বেতন দিয়েছে ছাত্রের মা। লিমনের বাবা-মা সেটাই বিশ্বাস করেছেন। যদি শুনতেন বোনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে, তাহলে অনেক ঝামেলা হতো। লিজাও বলেনি বাসায়। ভাইটাকে অনেক ভালোবাসে। ভেবেছে হয়তো ওর কোনো প্রয়োজন! তাই চাওয়ামাত্র স্বামীর কাছ থেকে নিয়ে দিয়েছে।
এর আগেও একবার বোনের কাছ থেকে টাকা নিতে হয়েছে লিমনকে। বোনের বিয়ের প্রথম সপ্তাহেই লিমন একটা ছোটখাটো বিপদে পড়ে গিয়েছিলো। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার সময় পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় সবাইকে। লিমনকেও নিয়ে যায়। তার কোনো এক বন্ধু মাদক কেনাবেচার সাথে জড়িত ছিলো। এলাকার এক বড় ভাই গিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে আনে। লিমনের কাছে কোনো টাকা পয়সা ছিলো না। থানা থেকে বের হয়ে উপায় না দেখে বোনকে জানায় সব। জরুরিভাবে তিন হাজার টাকা প্রয়োজন। বিয়ের মাত্র সাত দিনের মাথায় লিজা প্রথম টাকা চেয়েছিলো স্বামীর কাছে। প্রচণ্ড লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিলো লিজার! কারণ লিজার হাতে টাকাপয়সা থাকে না। প্রয়োজন পড়ে না। যা কিছু প্রয়োজন হয়, সুজন এনে দেয়। ছোট ভাইয়ের বিপদ বলেই টাকাটা চাইতে হয়েছিলো। সুজনও কিছু জিজ্ঞাসা না করেই টাকা দিয়েছে। কোনো প্রশ্ন করেনি। দ্বিতীয়বার টাকা চাওয়ার সময়ও কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। আজকে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো!
- টাকা দিয়ে কি করবে?
- না মানে, একটু দরকার ছিলো।
- ঠিক আছে। এই যে রইলো টাকা।
বলেই টেবিলে ২ হাজার টাকা রেখে অফিসে চলে গেলো সুজন। টাকাটা তুলতে গিয়ে নিজের কাছেই লজ্জায় মরে যাচ্ছিলো লিজা! বাড়ির কেয়ারটেকার সেলিম কে ডেকে ছোট ভাইয়ের নাম্বারটা দিয়ে বললো, টাকাটা বিকাশ করে এসো।

...পরের দিন ফর্ম ফিলাপ করে কলেজ থেকে বের হতেই চমকে গেলো লিমন। একি দুলাভাই !! হঠাৎ কলেজের সামনে! হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে বললো, দুলাভাই আপনি এখানে? গম্ভীর চেহারায় লিমনকে গাড়িতে উঠার ইঙ্গিত দিলো সুজন। লিমন গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখলো তার আপা লিজা বসে আছে পেছনের সিটে। চোখের কোনায় জল জমে আছে!
- কি হয়েছে আপু?
লিজা কোনো উত্তর দিলো না। গাড়ির জানালার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। লিমন বুঝতে পারলো সমস্যাটা তার কারণেই হয়েছে। বোনের কাছে টাকা চাওয়াটা উচিত হয়নি। নতুন সংসার! দুলাভাই নিশ্চয়ই রাগ করেছে। দুজনেই নিস্তব্ধ হয়ে গাড়িতে বসে রইলো।
লিজার বাড়ির সামনে গাড়ি থামলো। ভয় পেয়ে গেলো লিমন! বাড়িতে বাবা মা আছে। দুলাভাই কি তাহলে উনাদের সাথে খারাপ আচরন করতে এসেছেন? গাড়ি থেকে নেমেই দুলাভাইয়ের সামনে এসে লিমন বললো, দুলাভাই কি হয়েছে! আমি কি কোনো ভুল করেছি?
ভেতরে চলো। ভেতরে গিয়ে কথা বলি। বলেই এগিয়ে গেলো লিমন। কাঁপতে কাঁপতে গাড়ি থেকে নামলো লিজা। এমন মুহুর্তের কথা কল্পনাও করেনি সে।
দরজা খুলতেই জামাইকে দেখে আকাশ ভেঙে পড়লো লিজার মায়ের মাথায়! যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না! পাগলের মতো ছোটাছুটি শুরু করে দিলেন তিনি। কি করবেন, না করবেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না! লিজার বাবাও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন! জামাইকে বসিয়ে নিজেই ছটফট শুরু করলেন। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে প্রথম এলো সুজন। তাই লিজার বাবা মায়ের ব্যস্ততার যেন শেষ নেই! এদিকে লিজা আর লিমন, দুই ভাই-বোন ভয়ে নির্বাক হয়ে আছে। বাবা মায়ের কোনো কথাই কানে যাচ্ছে না তাদের!
- মা, ব্যস্ত হবেন না। আপনি বসুন। আমি একটা বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি। বাবা, আপনিও বসুন। কিছু জরুরি কথা ছিলো।
জামাইয়ের কথায় যেন থমকে গেলো দুজনেই। ব্যস্ততা ঝেড়ে ফেলে এসে বসলেন সামনে। কিছুটা ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করলেন শাশুড়ি নিজেই।
- কি হয়েছে বাবা? হঠাৎ তুমি এলে। আমাদের তো কিছুই জানালে না। লিজাও তো জানালো না! কি আশ্চর্য্য! তুমি আমাদের একমাত্র জামাই। এভাবে আসতে হয়? একবার বললে কি হতো বাবা?
- অফিস থেকে সরাসরি এসেছি। আসার আগে লিমনের কলেজ হয়ে এসেছি। আসলে একটা অভিযোগ ছিলো। আপনার মেয়ের নামে।
- অভিযোগ? কি করেছে লিজা?
অনেকটা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠেই প্রশ্ন করলো লিজার বাবা।
- আপনার মেয়ে লুকোচুরি করেছে আমার সাথে।
- লুকোচুরি??
- জ্বি। লুকোচুরি। আমার সাথে লুকোচুরি হচ্ছে। হয়তো আপনারাও করছেন। তবে এখন আর লুকোচুরির কিছু নেই। আমি অনেক কিছুই জানি।
- মানে? কি হয়েছে বাবা? একটু খুলে বলো না!
ভয় আর লজ্জায় লিজার মায়ের কন্ঠ ভেঙে এলো!
- মা, গতকাল লিজা আমার কাছে দুই হাজার টাকা চাইলো। আমি কারণ জিজ্ঞাসা না করেই সেটা দিয়ে দিয়েছি। ভেবেছিলাম ওর কিছু প্রয়োজন। যদিও ওর সব ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিষ আমি কিনে দেই। ওর চাহিদার সবকিছু দিয়ে বাড়ি পরিপূর্ণ থাকে। তারপরও সে যখন টাকা চায়, আমি কারণ জিজ্ঞাসা করি না। এই নিয়ে তৃতীয়বার আমি আপনার মেয়েকে টাকা দিয়েছি। টাকাটা সে নিজের জন্য নয়, তার ভাইয়ের জন্য খরচ করেছে। মানে টাকাটা লিমনকে দেয়া হয়েছে। আমি প্রথমে খোঁজ নিয়েছি লিমন টাকা নিয়ে কি করলো? উঠতি বয়স, হয়তো বাজে সঙ্গের সাথে মিশছে। তাই খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তার কলেজের ফর্ম ফিলাপের জন্য টাকাটা প্রয়োজন ছিলো। যা তার বোনের কাছ থেকে নিয়েছে। এর আগেও আমি যে দুইবার টাকা পাঠিয়েছিলাম, সেটা লিমনকেই দেয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, সেটা লিমন পরিবারের জন্যই খরচ করেছে। কোথাও নষ্ট করেনি।
সুজনের অভিযোগ শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখলেন লিজার বাবা মা। কি বলবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একবার লিমনের দিকে, আরেকবার লিজার দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলেন তারা! লজ্জায় চোখে পানি জমে যাচ্ছে!
সুজন এগিয়ে এসে লিজার মায়ের হাত ধরে বললো-
মা, আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করেছি আমার বাবার অনুরোধে। উনি লিজাকে দেখেই পছন্দ করেছেন। উনি সবসময় চাইতেন, মার্জিত পরিবারের কেউ আমার স্ত্রী হোক। আভিজাত্য, উচ্চ বংশ কিংবা উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েদের কখনো উনি ঘরের বউ হিসেবে পছন্দ করতেন না। তাই আমার স্ত্রী হিসেবে আপনাদের মেয়েকেই বেছে নিয়েছেন। আমিও বাবার কথার অবাধ্য হইনি। বিয়ের আগে লিজার ছবিটা পর্যন্ত আমি দেখিনি। আমি আমার বাবাকে বিশ্বাস করি। উনার পছন্দ খারাপ হতে পারে না। উনি আমার জন্য যা কিছু করেছেন, সবকিছুই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার। ভেবেছিলাম আপনার মেয়ের ক্ষেত্রেও সেটাই হবে।
বিয়ের পর থেকেই আমি লিজাকে বোঝার চেষ্টা করছি। তবে নিজেকে কখনো বোঝার সুযোগ দেইনি আপনার মেয়েকে! আমি জানি আপনার মেয়ে আমাকে অনেক ভালোবাসে। হ্যা, আমিও বাসি। আমি লিজাকে ভালোবাসি! কিন্তু আমি চেয়েছিলাম, সে নিজেকে আমার কাছে সমর্পণ করুক। তাই তাকে যথেষ্ট স্পেস দিচ্ছিলাম।
তবে সে আমাকে ভালোবাসলেও আপন করতে পারেনি হয়তো। আপন করলে নিজের সুখ দুঃখের কথা আমার সাথে নিঃসঙ্কোচে শেয়ার করতো। ওর প্রতি যতটা অভিযোগ, ততটাই অভিযোগ আপনাদের প্রতি। কারন আপনারাও আমাকে সন্তান হিসেবে মেনে নিতে পারেন নি। শুনেছি মেয়ের জামাইকে ছেলে হিসেবেই মেনে নেয়া হয়। আমি আপনাদের জামাই হলেও, ছেলে হতে পারিনি! পরিবারে এতো ঝড় বয়ে যাচ্ছে, অথচ একবারও আমাকে বলার প্রয়োজন মনে করেন নি। দুই মাস আগে বাবা স্ট্রোক করেছিলেন, সেটা পর্যন্ত আমাকে জানানো হয়নি। আমাদের বিয়ের জন্য এতো টাকা লোন নিয়েছেন, প্রতি মাসে সেই সুদ টেনে যাচ্ছেন, এটাও আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেন নি। এমনকি আপনার মেয়েও একবার আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি।
আচ্ছা মা বলুন তো, মেয়ের বিয়ে মানে কি শুধুই মেয়েকে বিদায়ের দায়িত্ব? আর কিছুই নয়? মেয়েকে যেমন বিদায় দিলেন, তেমনি একটা ছেলেকেও তো আপন করলেন! পরিবারের অংশ বানালেন! তাহলে এতো লুকোচুরি কিসের মা? কেন এতো লুকোচুরি?
আমি মানছি, আমি একটু অন্যরকম মানুষ। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন পূরণের পথে ছুটেছি। কিন্তু আমার ভেতরটা অনেকেই বুঝতে পারে না! যেমনটা আপনার মেয়েও পারেনি। তার কাছে আমি শুধুই একজন স্বামী, যে রোবটের মতো অফিসে যায়, রাতে বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে ঘুমায়! অথচ আপনার মেয়ে এটাও জানে না, আমি প্রায় সময় মাঝরাতে উঠে ওর মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকি! নাশতা করার সময় আড়াল চোখে দেখি ওর ব্যস্ততা! এমনকি আমার মানিব্যাগেও আপনার মেয়ের ছবিটা সবসময় থাকে, সেটাও সে জানে না! আমি অন্য সকলের মতো ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি না হয়তো। তবে আমিও ভালোবাসি। নিজের মতো করে! আমি ভালোবাসি আপনার মেয়েকে। অনেক ভালোবাসি মা!
লিজার বাবা মা দুজনেই নিস্তব্ধ হয়ে আছেন! চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে দুজনের। কষ্ট না সুখের কান্না, বুঝতে পারছেন না। তবে তৃপ্তির! প্রচন্ড তৃপ্তির এই কান্না! লিজা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুজনের দিকে! যেন নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না! ইচ্ছা করছে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে সুজনকে। সুজনের বুকে মাথাটা রেখে প্রচন্ড কাঁদতে ইচ্ছা করছে লিজার! এতোটা বোকা মেয়ে সে? স্বামীর ভালোবাসাটুকু অনুভব করতে পারেনি কখনো!

লিজা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুজনের দিকে! যেন নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না! ইচ্ছা করছে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে সুজনকে। সুজনের বুকে মাথাটা রেখে প্রচন্ড কাঁদতে ইচ্ছা করছে লিজার! এতোটা বোকা মেয়ে সে? স্বামীর ভালোবাসাটুকু অনুভব করতে পারেনি কখনো!
সুজনের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে লিজা! লিমনও কাঁদছে দেয়ালের সাথে নিজেকে হেলিয়ে দিয়ে।
কথাগুলো শেষ করে এগিয়ে এলো সুজন। লিজার বাবা মা দুজনের সামনে হাটু গেড়ে বসলো। বলে উঠলো-
আজ থেকে আমি আপনাদের বড় ছেলে। আপনাদের যা কিছু সমস্যা, সব আমার সাথে শেয়ার করবেন। এখানে লজ্জা বা সংকোচের কিছুই নেই। এটা আপনাদের অধিকার। হয়তো এই আধুনিক সমাজ আমাদের অনেক অধিকার দেয় না। তবে অধিকার বুঝে নিতে হয়। কেড়ে নিতে হয়! আপনার মেয়ের বদলে আপনারা একজন ছেলে পেয়েছেন। এটাই বিয়ের একমাত্র অধিকার। বিয়ে মানে শুধু বিদায় নয়, বিয়ে মানে একটি নতুন সম্পর্কের সূচনা। ছেলে হিসেবে আমার বাবা মায়ের প্রতি যেমন আমার দায়িত্ব আছে, তেমনি আপনাদের প্রতিও আমার দায়িত্ব আছে। কারণ আপনাদের মেয়ে আমার ভালো থাকার দায়িত্বটা নিয়েছে। তাই তার পরিবারকে সুখে রাখার দায়িত্বটাও আমার নেয়া উচিত। তাই না মা?
'হ্যা বাবা। তুমি ঠিক বলেছো। আমরাও তোমার দায়িত্ব! তুমিও আমাদের সন্তান।'
কান্নাভেজা কণ্ঠে বললেন লিজার মা! কথা বলার মতো শক্তি তার কণ্ঠে নেই! প্রচন্ড মমতায় তার কন্ঠ জড়িয়ে আসছে।
ঠিক আছে। এটা সবসময় মনে রাখবেন। আমি যেন আর কখনো কোনো অভিযোগ করার সুযোগ না পাই! আজ থেকে এই পরিবারের বড় সন্তান আমি। আপনাদের সুখ দুঃখ কষ্ট, সবকিছু জানার অধিকার আমার রয়েছে। আমি আমার সেই অধিকার চাওয়ার জন্যই এসেছি।
নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে আর ব্যবসাকে উচ্চতার শিখরে নিতে গিয়ে নিজেকেই যেন হারিয়ে ফেলেছি! কাজ আর কাজের ব্যস্ততার মাঝে পরিবারের সাথে অনেক সুন্দর মুহূর্ত মিস করেছি। একটা যান্ত্রিক মানুষের মতোই বেচেঁছি সবসময়। ঠিক যেন একটা রোবট! কিন্তু আমিও ভালোবাসতে জানি। হয়তো ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি না! ধীরে ধীরে শিখে নেব! যদি আপনার মেয়ে শিখিয়ে দেয় তবে!!
সুজনের কথাগুলো শুনে এবার নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না লিজার মা। কাছে এসে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন! এ কান্নায় কোনো কষ্ট নেই! প্রচন্ড সুখ, প্রচন্ড নির্ভরতা! এই কান্না যেন প্রতিটা বাবা মায়ের ভাগ্যে থাকে!
নিজেকে সামলে নিয়ে সুজন বলে উঠলো, এই শালাবাবু কোথায় তুমি!
- এইতো আমি দুলাভাই! সুজনের কাছে এগিয়ে এলো লিমন।
- চলো একটু বাইরে যাই। সামনে একটা বাজারের মতো দেখলাম! ওখানে ভালো মাছ পাওয়া যায়? আর খাসির মাংস পাওয়া যায়?
চোখ মুছতে মুছতে লিমন বললো-
- হ্যা দুলাভাই, সব পাওয়া যায়। ছোট হলেও জমজমাট বাজার।
- ভেরি গুড। চলো তাহলে। আজ মায়ের হাতের রান্না করা খাসির মাংস খাবো। আর সর্ষে দিয়ে ইলিশ মাছ। আমার খুব প্রিয় খাবার। তোমার বোনের হাতের রান্না খেয়ে রুচি কমে যাচ্ছে। আজ মায়ের হাতে রান্না খেয়ে রুচি বাড়াতে হবে।
সুজনের কথায় হেসে উঠলো সবাই। সুখের হাসি। কান্নাভেজা হাসি! লিজার মা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেলেন। কতো কাজ করতে হবে! যেন প্রাণ ফিরে পেলেন আজ! আজ থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মা তিনি। এতো সুখ কেউ পায়??
লিজা এখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার স্বামীর দিকে। যেন নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সুজন এগিয়ে এসে লিজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বিকালের মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে। তুমি কিন্তু থেকে যাওয়ার বায়না করো না! আমি একলা ফিরতে চাই না। মাঝরাতে তোমার ঘুমন্ত মুখটা না দেখলে ভালো লাগে না। আর হ্যা, কথায় কথায় কান্নাটা একটু থামাও। তোমার চোখে পানি দেখতেও ভালো লাগে না। তারপর আরও কাছে এসে লিজার চোখে চোখ রেখে বললো-
"কান্না নয়, তোমাকে সমস্ত পৃথিবীর সুখ দিতে চাই। ভালোবেসে জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত তোমার হাতটা ধরে রাখতে চাই। এটাও আমার দায়িত্ব। আমার অধিকার।"
(সমাপ্ত)

গল্প : অধিকার

No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...